সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সরকারের পদত্যাগসহ নিজের এক দফা দাবিতে অনড় আছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এরই মধ্যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশের রাজনীতি, নির্বাচন ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ টিভিকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এম আকাশ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জুয়েল বিশ্বাস।
দেশ টিভি: বাকশাল গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে সিপিবি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। কী কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবির দূরত্ব তৈরি হলো?
এম এম আকাশ: বাকশাল গঠনের সময় থেকে সিপিবি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল এ কথা সঠিক নয়। বরং সিপিবি বাকশালে যোগ দিয়েছিল বাধ্য হয়ে। সিপিবির যে গোপন রাজনৈতিক প্রস্তাব ছিল তাতে লেখা ছিল, আমরা বঙ্গবন্ধুর এই প্রস্তাবে যোগ দিয়ে চেষ্টা করব প্রগতিশীলতার পথে দেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যতটুকু সম্ভব ততটুকু। বাকশালের কর্মসূচি ঠিক ছিল, কিন্তু বাকশালের যে কমপজিশন সে ব্যাপারে আমাদের আপত্তি ছিল। আমরা তাই এক দলীয় ব্যবস্থা চাইনি। চেয়েছিলাম মৈত্রী জোট। তো মৈত্রী জোট না হওয়াতে, একদলীয় ব্যবস্থা হওয়াতে আমরা তখন বাধ্য হয়ে তাতে যোগ দেই। যোগ দিয়ে বেস্ট আউট অব সামথিং বানানোর চেষ্টা করি। এই ছিল আমাদের মূলত অবস্থান।
দেশ টিভি: বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আপনারা বলছেন তদারকি সরকার। আসলে দুটোর মধ্যে পার্থক্য কী?
এম এম আকাশ: আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন নিয়ে একটু সন্দিহান কারণ অতীতে বিএনপি এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের সময় যে বিধানটা ছিল যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে হবে, সেটাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য বিএনপি তখন জাজের রিটায়ারমেন্ট চেঞ্জ করে কেএম হাছানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানোর চেষ্টা করে। তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটা বিতর্কিত হয়ে যায়। সুতরাং এখনও এই বিতর্কিত অধ্যায়ে যাওয়ার কোনো স্কোপ নেই। বরঞ্চ আমরা তদারকি সরকার বলে একটা নিউট্রাল টার্ম ইউজ করেছি। যাতে সবাই মিলে বসে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, সরকারটা এমন হবে যারা ভোটে জনগণের মতামতকে প্রভাবিত করবে না বা ইলেকশন কমিশন এমন হবে, যারা একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার যেভাবে চালায় ঠিক সেভাবে চালাবে। সুতরাং এটা ঠিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেই যে নির্দলীয় হবে তা বিএনপির আমলে আমরা দেখেছি হয়নি। সুতরাং আমাদের এটা সবাই মিলে আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে এবং ওই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারেরই অপর নাম হচ্ছে তদারকি সরকার।
দেশ টিভি: গত আগস্ট মাসে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম বলেছিলেন, আমরা হলাম এক নম্বর বিরোধী দল। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
এম এম আকাশ: হ্যাঁ আসলেই তো আমরা এক নম্বর বিরোধী দল। কারণ বিরোধী দল মানে হচ্ছে নীতিগতভাবে এবং আদর্শগতভাবে বিরোধী। আমরা যদি নীতিগতভাবে এবং আদর্শগতভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধী না হতাম তাহলে আমরা বুর্জোয়া ধারার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ধরার কথা বলতাম না। আমরা যেহেতু মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে সুতরাং আমরা বিএনপিরও বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগেরও বিরুদ্ধে। সুতরাং বিএনপি আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব মুক্তবাজার প্রশ্নে নয় বা মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয়ে নয়।
একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ছিল। কিন্তু এখন বিএনপিও বলে দিয়েছে ভারত আমাদের শত্রু নয়, আমরা চাই ভারত নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকুক আর আওয়ামী লীগও বলে দিয়েছে ধর্মের প্রশ্নে আমরা আগের মতো জোরদার ভূমিকা গ্রহণ করব না। লাস্ট ২৮ অক্টোবর তারা (সরকার) জামায়াতকে মিটিং করার সুযোগ দিয়েছে, বিএনপিকে মিটিং করার সুযোগ দেয়নি। সুতরাং ওইদিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং ভারতের প্রীতি বা ভারতের প্রতি ন্যায্য বিরোধিতা এইসব প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বিএনপির বর্তমানে দূরত্ব কমে গেছে। সুতরাং আমরা মনে করি যে তারা উভয়েই যেহেতু এমন শ্রেণির দ্বারা পরিচালিত হন যারা অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের হর্তাকর্তা। আগে যেমন ২২ পরিবার ছিল, এখন হয়তো ২২শ’ পরিবার হবে। এই ২২শ’ পরিবারের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার যে রাজনীতি সেটাই হলো প্রধান বিরোধী রাজনীতি। আর ২২শ’ পরিবারের দ্বারা পরিচালিত যে পৃথক পৃথক রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষমতার পরিবর্তন, আদান-প্রদানে চলে গিয়ে আরেকজন আসা এটা হলো গদির বদল নীতির বদল নয়। সুতরাং আমরা যেহেতু নীতির বদলের পক্ষে আর অন্যরা যেহেতু গদির বদলের পক্ষে, সুতরাং গদির বদলকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই এক নম্বর বিরোধী দল।
দেশ টিভি: আগে বাম দলগুলো সরকারের ওপর যতটা প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারত। এখন কেন ততটা পারছে না?
এম এম আকাশ: এ কথা ঠিক যে আমাদের সংগঠন কিছুটা দুর্বল। আমাদের সাংগঠনিক শক্তির অভাবের কারণে আমাদের রাজনৈতিক লাইন সঠিক হওয়া সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে আমরা ততটা সাড়া তৈরি করতে পারিনি। এবং সরকারের ওপরেও ততটা প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারিনি। তবে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে শ্রমজীবী মানুষের ইস্যুতে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। তখন আমরা জনগণকেও সাড়ার মধ্যে আনতে পারব এবং সরকারের বিরুদ্ধেও প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারব।
দেশ টিভি: কিন্তু দিন দিন আপনাদের শক্তি কমে যাচ্ছে কেন?
এম এম আকাশ: ’৯০ সালে যখন সোভিয়েতের পতন হয় তখন আমাদের পার্টি ভেঙে যায়। যে কারণে আমাদের পার্টি দুর্বল হয়ে যায়। সেই দুর্বল অবস্থা থেকে আমরা কিছুটা অগ্রসর হয়েছি ঠিকই কিন্তু এখনও আমরা সারা পৃথিবীতে বামপন্থী জোয়ার আনতে পারিনি। এটা করতে পেরেছি আমরা যে সারা পৃথিবীতে নিও লিবারিজম উন্মোচিত হয়েছে এবং বামপন্থীদের আগে যেমন বলা হতো ক্যাপিটালিজম ইজ দ্য এন্ড অব হিস্ট্রি এখন আর কেউ সেটা বলে না। আগে বলা হতো টিনা- দেয়ার ইস নো অলটারনেটিভ। এখন এটা আর বলা হয় না। কিন্তু দেয়ার ইজ অলটারনেটিভ বলে যে শক্তিটা তৈরি করা দরকার সেটা এখনও পৃথিবীর কোথাও সেভাবে তৈরি হয়নি। অনেক জায়গাতেই পিছিয়েছে। আমরা মনে করি এটা একটা সাময়িক পশ্চাদাপসারণ। সুতরাং সেটা বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে বিশ্বাস করি না।
দেশ টিভি: মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সিপিবির অবস্থান কি? মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার পথ কতটা সুগম করবে? নাকি নিষেধাজ্ঞার পেছনে আপনি অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছেন?
এম এম আকাশ: মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসলে গণতন্ত্রের জন্য নয়। আমরা মনে করি আলটিমেটলি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। নির্বাচন হয়ে যাবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরও আগেই চলে যাবে, যদি আওয়ামী লীগ চীনের লবি থেকে বের হয়ে মার্কিন লবিতে যোগদান করে। এবং আমেরিকানদের প্রশান্ত এবং বঙ্গোপসাগরে যেসব যুদ্ধ এবং অন্যান্য আয়োজনের লক্ষ্য আছে সেই লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে যদি একত্রিত হয়ে চীনের বিরুদ্ধে এবং ভারতের সঙ্গে একত্রিত হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ, তাহলে গণতন্ত্র-টনতন্ত্র কোনো ইস্যু হবে বলে আমি মনে করি না।
দেশ টিভি: বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতি থেকে সরে জ্বালাও-পোড়াওতে পথ খুঁজছে। এটা কী তাদের দোদুল্যমান, দিশাহীন ও হতাশাব্যঞ্জক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ?
এম এম আকাশ: বিএনপি যে জ্বালাও-পোড়াও করে যে পথ খুঁজছে এটা এই কারণে এটা তাদের জন্য ডু অর ডাই ইলেকশন। তারা দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা থেকে বাইরে আছে, তাদের প্রধান নেতা তারেক জিয়াকে যদি পুনর্বাসিত না করতে পারে এবারও, তাহলে তাদের অর্থ সংকটও বাড়বে, তাদের দলের মধ্যে হতাশাও বাড়বে। এবং অনেক লোকই ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, তাদের দল থেকে ছুটে অন্যত্র যেয়ে নানাভাবে অবস্থান গ্রহণ করছে। সেই কারণে জ্বালাও-পোড়াও করে এটাকে যদি না ঠেকাতে পারে তাহলে দলই থাকবে না বলে তারা হয়তো ভাবছে।
দেশ টিভি: এইভাবে কী তারা সফল হতে পারবে?
এম এম আকাশ: এভাবে তারা সফল হতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। যদি না আমেরিকানরা প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করার জন্য আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর ও অন্যান্য সেক্টরের সঙ্গে বিরোধিতা করে। যদি না জাতিসংঘ সামরিক বাহিনীকে পিসকোর হিসেবে ব্যবহার করতে অস্বীকার করে। এইসব জিনিস হলে তখন হয়তো জ্বালাও-পোড়াও করে তারা সফল হতে পারে।
দেশ টিভি: নির্বাচনের আগে পোশাকশিল্প কারখানায় যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, সেটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? আবার বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশি পোশাক প্রত্যাহার করছে, এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
এম এম আকাশ: এখানে দু’রকম কারণেই আছে। একটা আছে জিও পলিটিক্যাল কারণে যারা বর্তমান হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা যদি নির্বাচনের অজুহাতে একটা চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে তারা সেই অর্থনৈতিক চাপ আরও বর্ধিত করার জন্য পোশাক শিল্পের ওপরেও চাপ দিতে পারে। তবে এটা দেবে কিনা এটা অনেকখানি নির্ভর করে ভারতের অভিমতের ওপর। যতদূর জানা যায় ভারত এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে খরচের খাতায় লেখেনি। সুতরাং ওই চাপ দেওয়ার আগে আমেরিকাকে দু’বার-তিনবার ভাবতে হবে। কারণ এশিয়াতে ভারতের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার মতো হঠকারিতা করে চীনের সঙ্গে আরও দুর্বল অবস্থানে চলে যেতে আমেরিকা চাইবে না।
দেশ টিভি: রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক যেকোনো মূল্যে ইসি নির্বাচন করতে চায়। ইসির এই বক্তব্যকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
এম এম আকাশ: যেকোনো মূল্যে ইসি নির্বাচন করতে চায় এটা ঠিক না। যেকোনো মূল্যে যদি ইসি সঠিক নির্বাচন করতে চায়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে চায় এবং যদি সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে চায় তাহলে যেকোনো মূল্যেই করতে হবে। যেকোনো মূল্যে করতে হলে যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, তদারকি সরকারের ডিজাইন করতে হবে, সবাইকে কনভিন্স করতে হবে, এই মূল্যগুলো তো ইসিকে দিতে হবে। ইসি যখন বলে যেকোনো মূল্যে আমি নির্বাচন করতে চাই। তখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে ইসির কাছে সেই মূল্যগুলো কী কী?
জেবি/এইউ