সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
‘আমি আমার ছেলের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারিনি, এর আগেই সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে। যাবার সময় সে বলে গেছে, সে আর ভার্সিটির হলে থাকবে না। হলে নাকি পড়ালেখার সমস্যা হয়। তাই সে চট্টগ্রাম শহরে একটি বাসা ভাড়া নিবে। এজন্য তাকে খরচের ৫-১০ হাজার টাকা বেশি দিতে হবে এমনই আবদার করেছিল ছেলেটা আমার কাছে। আমি তার শেষ ইচ্ছাটা রাখতে পারিনি।’
এমনই ভাবে আক্ষেপ করতে করতে বুকফাটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন চট্টগ্রামে বাসচাপায় নিহত হওয়া চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শান্ত সাহার (২২) বাবা কাজল সাহা। এ সময় শান্তর বাবার হৃদয়বিদারক কান্নায় নরসিংদী পৌর শহরের সেবাসংঘ মন্দিরের আশপাশ এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এ সময় স্বজন ও এলাকাবাসীও মেধাবী এই শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে নরসিংদী পৌর শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়ার সেবাসংঘে এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থী শান্ত সাহার মরদেহ নরসিংদীতে এসে পৌঁছে। এ সময় তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এদিকে মেধাবী ছাত্র শান্তর মরদেহ নরসিংদী এসে পৌঁছলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন কমিউনিটি নেতাসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসে ভিড় জমায়।
নিহত শান্ত সাহা সেবাসংঘ এলাকার বাসিন্দা কাজল সাহা ও শিউলি রাণী সাহা দম্পতির ছোট ছেলে। এই দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে শান্ত সাহা সবার ছোট। শান্ত সাহার বড় ভাই কৌশিক সাহা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক সিলেটের কোলাউড়া শাখায় কর্মরত আছেন। মেঝো ভাই পার্থ সাহা ভারতের হরিয়ানায় কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ছেন। আর সবার ছোট শান্ত সাহা চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের ২০তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
সেবাসংঘ দুর্গাবাড়ি মন্দিরের পাশেই নিহত শান্ত সাহাদের বাড়িতে মা শিউলি রাণী সাহা বুক ও কপাল চাপরাচ্ছে আর আহাজারি করছেন। তিনি বিলাপ করছেন আর কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছে। ‘আমার ইঞ্জিনিয়ার পোলা কই গেলো গো’ বলে বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা চোখে মুখেসহ মাথায় পানি দিয়ে কিছুটা সুস্থ করছেন।
মূর্ছা থেকে জ্ঞান ফিরে আবারও একইভাবে আহাজারি করে বলছেন, আমার সোনার চাক্কা আর নাই, আমিও আর বাঁচতে চাই না। পোলা ইঞ্জিনিয়ার হইয়া বিদেশে যাইব। আমারে কইছিল, মাগো, তোমারে বিদেশে নিয়া গিয়া চিকিৎসা করামু। আমার ইঞ্জিনিয়ার পুতে গেল কই? আমারে কে বিদেশ নিয়া যাইব? আমার পোলারে আইন্যা দেও তোমরা। এ সময় স্বজন ও প্রতিবেশীরা শিউলি রাণী সাহাকে সান্ত্বনা দেন।
এর আগে সোমবার শান্ত সাহা তার একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগের দুই জুনিয়র শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে রাঙ্গুনিয়া থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কাপ্তাই সড়কের সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছলে শাহ আমানত নামের দ্রুতগামী একটি বাস মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়।
এতে মোটরসাইকেলের আরোহী শিক্ষার্থীরা ছিটকে পড়েন। ঘটনাস্থলেই শান্তর মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত হন অপর দুজন। পরে আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তৌফিককে মৃত ঘোষণা করেন। আহত হিমু হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার পা ভেঙে গেছে। বর্তমানে সে আশঙ্কামুক্ত চিকিৎসক জানিয়েছেন।
নিহত শান্তের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ঈদ ও পয়লা বৈশাখের ছুটি বাড়িতে কাটিয়ে গত শনিবার রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশে নরসিংদী থেকে রওয়ানা দেয়। রোববার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে শান্ত তার বাবার মোবাইল ফোন করে ভালোভাবে পৌঁছেছে বলে জানায়। পরে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শান্তর সহপাঠীরা তার বড় ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা কৌশিক সাহার মোবাইলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর জানান।
পরিবারের সদস্যরা আরও জানায়, শান্তর মরদেহ আনার জন্য তারা চট্টগ্রামে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে জানায়, ময়নাতদন্ত শেষে ফ্রিজিং গাড়িতে করে শান্তর মরদেহ নরসিংদীতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ সময় পরিবারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাদের কোনো অভিযোগ নেই, মামলাও করতে চান না তারা। এ সময় ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তরের অনুরোধ জানান। পরিবারের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে সোমবার রাত ১০টার দিকে লাশবাহী গাড়ি নরসিংদীর উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে শান্তর মরদেহ নরসিংদী শহরের সেবাসংঘ এলাকা এসে পৌঁছায়। মরদেহ নিয়ে এসেছেন শান্তর হলের দুই সহকারী প্রভোস্ট মাসুম রানা ও সামিউন বশির এবং তার ৭ সহপাঠী।
জেবি