সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
১৯২০ সালে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টি বা কেন্ট অঞ্চল থেকে আবিষ্কার হয় পাথরের তৈরি হাতল। এ হাতলটি ছিল উত্তরাঞ্চলীয় ইউরোপে ২৬ লাখ বছর আগে শুরু হওয়া পাথর যুগের অন্যতম নিদর্শন। ইনফ্রারেড-রেডিওফ্লরেসেন্স ডেটিং-নামে একটি গবেষণা কৌশলের মাধ্যমে শিলা এবং বালির মধ্যে থাকা নির্দিষ্ট কিছু খনিজ উপাদানের সর্বশেষ সূর্যের আলো পাওয়ার সময় থেকে জানা যায় খনিজটি কত বছর আগে মাটির নিচে চাপা পড়েছিল। এ থেকে ওই খনিজ সংশ্লিষ্ট সময়ের ইতিহাসও ধারণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পাথর যুগের হাতলটি গবেষণা করে ধারণা করা হয়েছে, ৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬ লাখ ২০ হাজার বছর আগে ব্রিটেনের দক্ষিণাঞ্চলে আদি মানুষদের একটি অংশের বসতি ছিল। এই আদি মানুষদের পরিচিত ছিল নিয়ান্ডারথাল বা হোমো হাইডেলবারগেনসিস নামে। ওই সময়ে ব্রিটেন আলাদা কোনো দ্বীপরাষ্ট্র ছিল না, ছিল পুরো ইউরোপের একটি অংশ। ইউরোপের শিকারী জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে তখন কেন্ট উপকূলসহ আশপাশের এলাকায় শিকার করত এ আদি মানুষরা।
সেইসময়কার মানুষের ব্যবহার করা এমন অন্তত ৩৩০টি নির্দশন পাওয়া গেছে যেগুলো ব্যবহার হতো পশু জবাইয়ে। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে এই আদি মানুষ হাইডেলবারগেনসিসদের বিলুপ্তি ঘটে। ইউরোপের আদি মানুষদের বিলুপ্তি ঘটলেও আফ্রিকায় বসবাস করা হাইডেলবারগেনসিসরা টিকে যায়। আফ্রিকার এই মানবগোষ্ঠী থেকেই হোমোসেপিয়েনস বা বুদ্ধিমান মানুষদের বর্তমান ধারা চলমান রয়েছে প্রায় ৩ লাখ বছর ধরে। গত ৫০ হাজার বছর ধরে বুদ্ধিমান এই মানুষরাই পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। হোমোসেপিয়েন্সদের আগে ব্রিটেনে আরও ৮ ধরনের মানুষের বসবাস ছিল। আদি মানুষের মতো সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে ব্রিটেনে অন্য দেশের সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে।
৬২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৩টি ধাপে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ইউরোপের অধিকাংশ এলাকাই ছিল ইতালির রোমান সাম্রাজ্র্যের অধীনে। ৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেন দখলে নেয় রোমানরা। এরপর ৪১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন ছিল রোমানদের অধীনে। তখন ব্রিটেন এবং ওয়েলসকে ব্রিটানিয়া নামে শাসন করত ইতালি। সেসময় রোমানো-ব্রিটিশ কালচার নামে একটি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে ইংল্যান্ডে। ৫০০ থেকে ১৫০০ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত মধ্যযুগের শুরুর দিকে ব্রিটেনের অধিকাংশ এলাকায় বসবাস ছিল মধ্য ইউরোপের জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতিগোষ্ঠীর।
অ্যাংলো-স্যাক্সন ছিল মূলত একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, যারা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জার্মানিক ভাষার একটি শাখা ওল্ড ইংলিশ বা অ্যাংলো স্যাক্সন ভাষায় কথা বলত। একপর্যায়ে ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলে বসবাস করা নাগরিকরাও নিজেদের অ্যাংলো-স্যাক্সনদের অন্তর্ভুক্ত করে এবং ভাষা হিসেবে অ্যাংলো-স্যাক্সনকে গ্রহণ করে।
ইউরোপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, ম্যান দ্বীপ, ইনার এবং আউটার হেব্রীডস দ্বীপপুঞ্জ, স্কটল্যান্ডের উত্তর উপকূলের নর্দার্ন দ্বীপপুঞ্জসহ ছোট ছোট ৬ হাজার দ্বীপ নিয়ে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। একত্রে এ দ্বীপপুঞ্জের আয়তন ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৫৯ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ মানুষ এই অঞ্চলে বাস করে। এ এলাকায় ২টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উপস্থিতি রয়েছে একটি আয়ারল্যান্ড, অন্যটি ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড বা যুক্তরাজ্য।
মানুষের বসতির ইতিহাস লাখো বছর পুরোনো হলেও দেশ হিসেবে আধুনিক এবং শক্তিশালী ব্রিটেন গড়ে উঠেছে মাত্র ২ হাজার বছর আগে। ছোট-বড় প্রায় ১৬০০ রাজ্য এক হয়ে ব্রিটেনের ভিত্তি গড়ে ওঠে।
রোমান শাসনামল শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্য গড়ে ওঠে। এই রাজ্যগুলো এক হয়ে ওয়েলস সাম্রাজ্র্যের গোড়াপত্তন করে। শুরুর দিকে ওয়েলসে আয়ারল্যান্ডের প্রভাব ছিল। ৯ম শতকে ওয়েলসের শাসক রোডরি দ্য গ্রেট ওয়েলসের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নেন। ১০৫৫ সালে আয়ারল্যান্ডের নৌবাহিনীর সহায়তায় ওয়েলসের রাজা গ্রুফফিড অ্যাপ লাইওয়েলিন ব্রিটেনের কিছু অংশের দখল নেন। এর ১০ বছরের মধ্যে গ্রুফফিডের নিজ দেশের মানুষ তাকে হত্যা করে।
১০৭০ সালে ফ্রান্সের উত্তর অংশ থেকে ব্রিটেনে আসা নরম্যান জাতিগোষ্ঠী ওয়েলসে হামলা চালায়। প্রায় ২৭ বছর সময় ধরে চলা যুদ্ধে নরম্যানরা ওয়েলসের অনেকটা দখলে নিয়ে নেয়। ১০৯৪ সালে ওয়েলসের জনগণের একটা বড় অংশ ওয়েলসকে পুনর্দখলে নরম্যানদের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা শুরু করে। কয়েক দশকের মধ্যে নরম্যানদের হটিয়ে ওয়েলসে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করে ওয়েলসের এ যোদ্ধারা। ১২৪০ সালে ওয়েলসের শাসক লাইওয়েলিন দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর তার পুত্র ডাফিড অ্যাপ লাইওয়েলিন ক্ষমতায় আরোহণ করতে গেলে বাধা দেয় ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় হেনরি। যে কারণে ওয়েলসে সঙ্গে ব্রিটেনের যুদ্ধ শুরু হয়।
১২৭২ সালে হেনরির মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র প্রথম এডওয়ার্ড। তখন বংশপরম্পরায় ওয়েলসের ক্ষমতার দাবি করেন ডাফিডের ছেলে লাইওয়েলিন অ্যাপ গ্রুফফিড। গ্রুফফিডকে পরাজিত করে ওয়েলসের দখল নেয় ইংলিশরা। ১৫৩৬ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ওয়েলস পরিচালনার আইন হিসেবে লজ অব ওয়েলস অ্যাক্টস ১৫৩৫ পাস করেন। যে আইনে ২১ হাজার ২১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ওয়েলসকে ইংল্যান্ডের অধিভুক্ত ঘোষণা করা হয়। ওয়েলসের জনগণের ওপর ইংরেজদের আইন এবং ইংরেজি ভাষা ব্যবহার এবং ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ওয়েলস থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ নিয়মও তখন চালু হয়। যদিও ১২৮৪ সালে প্রথম এডওয়ার্ডের সময় থেকেই ওয়েলস অনেকটা ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বর্তমান যুক্তরাজ্যের আরেকটি অংশ ৮০ হাজার ২৩১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের স্কটল্যান্ড। ৮৪৩ সালে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডের আয়তন কখনও বেড়েছে আবার কখনও কমেছে। রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাবের পর থেকেই প্রতিবেশী স্কটল্যান্ড দখলে হামলা শুরু করে ব্রিটেন। ১৩০৬ থেকে ১৩২৯ সাল পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট দ্য ব্রুস ছিলেন সে সময়ে আলোচিত শাসক। তার নেতৃত্বে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ১৩২৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ করে স্কটল্যান্ড, যা ইতিহাসে স্কটল্যান্ডের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যভুক্ত হয় ১৭০৭ সালের ১ মে, ট্রিটি অব ইউনিয়নের মাধ্যমে। এ চুক্তির আওতায় স্কটল্যান্ড সাম্রাজ্য এবং ইংল্যান্ড সাম্রাজ্য এক হয়ে পরিচালিত হতে শুরু। যদিও ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড এক হওয়ার সিদ্ধান্তটা আরও আগে থেকেই নেওয়া হয়েছিল। ১৫৬৭ সাল থেকে স্কটল্যান্ডের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ৬ষ্ঠ জেমসকে ১৬০৩ সালের ২৪ মার্চ ইংল্যান্ড সাম্রাজেরও রাজা করা হয়। স্কটল্যান্ড এবং ব্রিটেনের মধ্যে ইউনিয়ন অব দ্য ক্রাউন চুক্তির আওতায় একসঙ্গে ব্রিটেন এবং স্কটল্যান্ড-দুই দেশেরই রাজা হন ৬ষ্ঠ জেমস। ১৬২৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৬ষ্ঠ জেমস স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন।
যদিও ইংল্যান্ডের সঙ্গে স্কটল্যান্ডের এক হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় একটি বৈবাহিক সম্পর্ককে। ১৫০৩ সালে স্কটল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জেমস ইংল্যান্ডের রাজা ৭ম হেনরির মেয়ে মার্গারেটকে বিয়ে করেন। বিয়ের এক বছর আগে ১৫০২ সালে চতুর্থ জেমস ৭ম হেনরির সঙ্গে ট্রিটি অব পারপ্যাচুয়াল পিস বা স্থায়ী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে, যে চুক্তির কারণে প্রায় ২০০ বছর ধরে স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে চলা যুদ্ধ শেষ হয়।
যুক্তরাজ্যের আরেকটি অংশ ১৪ হাজার ৩৩০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের উত্তর আয়ারল্যান্ড। উত্তর আয়ারল্যান্ড, বর্তমানের আয়ারল্যান্ড রাষ্ট্রের একটি অংশ ছিল। আইরিশভাষী আদি গেইলস জাতিগোষ্ঠী দীর্ঘদিন উত্তর আয়ারল্যান্ডে বসবাস করেছে। ১১৬৯ সালে আয়ারল্যান্ড দখলে নেয় ব্রিটেন। যদিও পুরো আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে আসে ১৬০৩ সালে টুডোদের শাসনামলে। ১৪৮৫ থেকে ১৬০৩ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে টুডোর নামে পরিচিত ওয়েলসের ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। টুডোদের প্রথম রাজা ছিলেন ৭ম হেনরি। ১৮০১ সালে কিংডম অব আয়ারল্যান্ড এবং কিংডম অব ইংল্যান্ডে মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হয় আয়ারল্যান্ড।
১৯১৯ থেকে ১৯২১ সালে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীন হতে চাওয়া অংশটি। এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২১ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে আইরিশ দ্বীপে প্রায় ৬ ভাগের ৫ ভাগ নিয়ে গঠিত আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীনতা দেয় ব্রিটেন। তবে উত্তর আয়ারল্যান্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনেই থেকে যায়। ১৯২২ সাল থেকে ব্রিটেন, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে বর্তমানের যুক্তরাজ্য গঠিত। যুক্তরাজ্যের অধীনে থাকলেও স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলসের রয়েছে নিজস্ব আইনসভা। এসব আইনসভায় তৈরি আইন দিয়ে প্রদেশগুলো পরিচালিত হয়। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রধান হিসেবে ব্রিটেনের রাজা অথবা রানী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া আইনে অনুমোদন এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন রাজা অথবা রাণী। যুক্তরাজ্যভুক্ত প্রদেশগুলোও ব্রিটেনের রাজা অথবা রাণীর অনুমোদনেই পরিচালিত হয়।
এইউ