সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
ভারতের মেঘালয় রাজ্যে সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয়েছে ‘নকরেক পার্ক’। এখানে গেলে মনে হবে আপনি মেঘের উপর ভেসে বেড়াচ্ছেন। এ যেন ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরের সেই ‘ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান’ এর মতো সাজানো।
সত্যিই তাই। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১২ শত ফুট উচ্চতায় দারেবোকগ্রে এলাকার পাহাড়ের ওপর এ নকরেক পার্কটি তৈরি করা হয়েছে। এ পার্কের চারপাশ ঘিরে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি উঁচু উঁচু পাহাড়। যা দূর থেকে নকরেক পার্ককে মনে হবে মেঘের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে।
আর দূরের ওই পাহাড় থেকে মাঝে মধ্যে দল বেঁধে কিছু মেঘ আছড়ে পড়ে সেই পার্কে। এ সময় ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্রমণকারী বা পর্যটকদের অন্যরকম শিহরণ জাগায়। তবে এ দৃশ্য কেবল জুলাই থেকে আগস্ট মাস অর্থাৎ ভরা বর্ষা মওসুম পর্যন্ত উপভোগ করা যায়।
মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি মেঘালয়ের দারেবোকগ্রে নকরেক জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন ভিউয়িং ডেক এবং নক আচিক বা এই ‘নকরেক পার্ক’ উদ্বোধন করেছেন। পার্কটি মেঘালয়ের দক্ষিণ গারো পাহাড় জেলার তুরা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব গারো পাহাড় জেলার উইলিয়ামনগর শহরের সন্নিকটে। এটির ভিউয়িং ডেক নকরেক এর আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপের একটি প্যানোরামিক ভিউ দেখায় যা গারো পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি টেকসই এবং দায়িত্বশীল অবকাঠামো বিকাশের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রক তার স্বদেশ দর্শন প্রকল্পকে স্বদেশ দর্শন হিসাবে পুনর্গঠন করেছে। স্বদেশ দর্শন এবং প্রসাদ (তীর্থযাত্রা পুনর্জীবন ও আধ্যাত্মিক, হেরিটেজ অগমেন্টেশন ড্রাইভ) প্রকল্পের অধীনে পর্যটন মন্ত্রক রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
মূলত মেঘালয়ের পূর্বাংশের খাসিয়া পাহাড় বেষ্টিত শিলং পর্যটন বা ট্যুরিজম গড়ে উঠলেও মেঘালয়ের পশ্চিমাংশের গারো পাহাড় বেষ্টিত তুরা ও উইলিয়াম নগর এলাকায় এখনো কোন ট্যুরিজম গড়ে উঠেনি। এসব এলাকার কোন দর্শনীয় স্থান গুগলে খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে ভারতীয় কিছু ব্লগার তুরা ও উইলিমায় নগর এলকায় ভ্রমণ করে সেসব এলাকার ভিডিও চিত্র প্রকাশ করলেও নেই বিস্তারিত কোন তথ্য। ফলে বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার নাঁকুগাও-ভারতের ঢালু সীমান্ত দিয়ে সম্প্রতি ভ্রমণপিপাসু ও পর্যটক তুরা শহরে ভ্রমণে গিয়ে কোন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারছে না।
কারণ, ভ্রমণের জন্য দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘুরতে কোন গাইড নেই তুরা শহরে। সেখানের কোন কার, টেক্সি বা সুমো টাটা ডাইভার ভ্রমণকারীদের নিয়ে দর্শনীয় স্থান ঘোরানোর পরিবেশও তৈরি হয়নি। তবে বাংলাদেশ থেকে তুরা শহরের স্থানীয় কিছু গারো সম্প্রদায়ের সঙ্গে পূর্ব পরিচিতির সুবাদে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ হয়। সম্প্রতি আমি ও আমার এক বন্ধুকে নিয়ে আমার জেলার পাশেই ইমিগ্রেশন-কাস্টমস শেষে মাত্র ৩/৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওই তুরা শহরে বেড়ানোর উদ্দেশে পৌঁছে যাই।
তুরা শহরটি আমার পূর্ব পরিচিত এবং স্থানীয় অনেক পরিচিত গারো বন্ধু রয়েছে। তাদের সুবাদে এবারই প্রথম জানতে পারি তুরাতে বর্তমান স্থানীয় এনপিপি সরকার প্রধান বা মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা এখানে ট্যুরিজম গড়ে তুলতে এবং রাস্তা উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় তুরা শহরের আশপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘নকরক পার্ক’। ওই পার্কের পাশেই রয়েছে স্থানীয় ন্যাশনাল পার্ক। এটি শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় দারেবোকগ্রে এলাকায়।
ওই পাহাড়ি এলাকার রাস্তাগুলো একসময় সরু ও ভাঙ্গাচোরা থাকলেও সম্প্রতি তা সংস্কার করা হয়েছে। ফলে মাত্র ২ থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় সেখানে। আমার তুরা শহর থেকে সারাদিনের জন্য ৪ হাজার রুপিতে একটি টেক্সি ভাড়া নিয়ে প্রথমেই নকরেক পার্ক দেখতে বেড়িয়ে পড়ি। ভারতের অন্য প্রদেশের চেয়ে এখানে টেক্সি ভাড়া একটু বেশি। কিন্তু ভ্রমণের চিন্তা করলে এটা খুব বেশি না। আঁকাবাঁকা রাস্তা হলেও গভীর জঙ্গল ভেদ করে সাঁ সাঁ করে জিপ বা টেক্সি ধরে যখন আপনি বন-পাহাড়ের চূড়ার দিকে ছুটে যাবেন তখন নিজেকে আমাজান জঙ্গলের অনুভূতি ছুয়ে যাবে।
পাহাড়ের চূড়ার দিকে নকরেক পার্কের কাছাকাছি এলেও আপনার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি কমলা বাগান। সেই বাগানের প্রতিটি গাছে হাজার হাজার কমলা দুলছে। যদিও এখন কমলার সিজন নয়। তবুও গাঢ় সবুজ রঙের এ কমলা বাগান দেখে আপনি বিমোহিত হয়ে যাবেন। টেক্সি চালককে বলতে বাধ্য হবেন, ‘দাদা একটু দাঁড়ান, আমি কমলাগুলো একটু ছূয়ে দেখবো।’ আপনি যদি কমলার সিজনে অর্থাৎ নভেম্বর মাসে আসেন তবে কমলা বাগানের মালিককে না খুঁজেই নিজের অজান্তেরই গাছ থেকে কমলা ছিড়ে খাওয়া শুরু করবেন।
যদিও ওইসব বাগান মালিক টুরিস্টদের জন্য ছাড় দেন। আমাদের সাথের গাইড তুরা শহরের বন্ধু বিজন জেসপার জানায়, এসব বাগানের কমলা মওসুমে সময় বাগান মালিকরা কাউকে বাঁধা দেয় না। তাদের ইচ্ছেমতো বাগানে ঢুকে কমলা খেতেও পারে এবং কিনেও নিতে পারে। আমাদের টেক্সি চালক ছিলো খুবই অভিজ্ঞ। তাই সে আমাদের সঙ্গে গল্পের পাশাপাশে সাঁ সাঁ করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ডান-বাম মোচড় দিয়ে পাহাড়ের উপরের দিকে।
এদিকে নিচু থেকে উপরের দিকে উঠে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপ পরিবর্তন হওয়ায় আমাদের কান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। স্পষ্ট করে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। একপর্যায়ে নকরেক পার্কের কাছাকাছি চলে আসলে কান স্বাভাবিক হয়ে যায়। এদিকে কমলা বাগানের পাশাপাশি কিছু স্থানে নাসপাতি গাছও চোখে পড়লো আমাদের। এবারও যাত্রাবিরতি দিতে বাধ্য হলাম। আমাদের বন্ধু গাইড বিজন জানায়, ‘খান দাদা নাসপাতি গাছ থেকে ছিড়ে খান, কেউ কিছু বলবে না।’ তার বলা আর সাথে সাথেই আমরা গাছ থেকে নাসপাতি ছিড়ে খেতে শুরু করি।
অসাধারণ স্বাদ এবং অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে বেশ কয়েকটা নাসপাতি খাওয়া শেষ করে পৌঁছে যাই নকরেক পার্কের প্রধান ফটকে। দেখলাম ৫০ টাকা করে এন্টি ফি এবং কার পার্কের জন্য আরো ৫০ টাকা ধরা হয়েছে। যথারীতি পার্কিং ও এন্টি ফি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম ‘নকরেক পার্কে’। অসাধারণ ভিউ দেখে কিছুক্ষণের জন্য আমরা থেমে যাই। আমাদেরও সেদিন ভালো কপাল ছিলো।
পার্কের সান বাঁধানো বিশাল মাঠের চারপাশ জুড়ে পাহাড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ করে এক দল মেঘ ছুটে এসে আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যায়। তবে ৪/৫ মিনিট পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলেও দূরের পাহাড়ে মেঘগুলোকে পাহাড়ের গাঁয় হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। আবারও হয়তো ছুটে আসবে যে কোন সময়। এমন দৃশ্য আসলে ক্যামেরাবন্দি করাও সম্ভব নয়। কিছু ধারণা নেয়া যায় মাত্র। ছবি শুধু ছবিই।
প্রকৃতির প্রকৃত রূপ মূলত কখনও ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করা যায় না। তবে মনের মনিকোঠায় আঁটকানো যায়। আমরাও তাই নকরেক পার্কের প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য মনের মনি কোঁঠাতেই বন্দি করে নিয়ে আসতে পেয়েছি মাত্র। তবে ক্যামেরার দৃশ্যগুলো প্রকৃতির কিছুটা চিত্র উঠে এসেছে। নকরেক পার্কের চারপাশের যে পাহাড় রয়েছে সেসব পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়া মেঘগুলোর কারণে পার্কটি দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন মেঘের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে ওই নকরেক পার্ক। পার্কের ভেতরে বসার জন্য রয়েছে একাধিক বেঞ্চ, বিভিন্ন ফুলের গাছ। রয়েছে কয়েকটি ধাপ। ধাপে ধাপে বেড়ানোর সময় পার্কের সৌন্দর্যও ধাপে ধাপে ভিন্নতা পায়। পার্কের মাঠটিতে টাইলস এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু ঘাস রোপণ করা হয়েছে। যা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি বৃষ্টি ভেঁজা মাঠে পর্যটকরা যেন পা পিছলে না পড়ে যায় সে ব্যবস্থাও রয়েছে। পার্কের একটু নিচে গারোদের স্থানীয় ঐতিহ্য বাঁশের ঘর নির্মাণ করে সেখানে তৈরি করা হয়েছে হলরুম।
বিভিন্ন সময়ে তারা তাদের কৃষ্টি-কালচারের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। নকরেক পার্কটি কয়েক মাস হয় চালু হলেও প্রতিদিন এখানে শত শত মানুষ ভিড় করে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই তুরা এলাকার মানুষ। তবে কিছু চাকরির সুবাদে তুরাতে বসবাসকারীও রয়েছে। এখানে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত অবস্থান করা যায়। তবে দূরের পর্যটকদের জন্য সন্ধ্যা পার করা নিরাপদ নয়। কারণ গহিন জঙ্গল ভেদ করে পৌঁছে হয় ওই পার্কে। ফেরার সময় ওই জঙ্গল পার হতে সন্ধ্যা হলে নানা বিপদের সম্ভাবনা থাকে।
তবে স্থানীয়রা রাত-বিরাতে চলাফেরা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা যেহেতু বিদেশি তাই বিকেল শেষ না হতেই অন্য স্পট দর্শনের জন্য সেখানে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ শেষ করে আবারও ছুটে চলি পাহাড়ের উচু-নিচু ও আঁকা-বাঁকা পথ ধরে। এবার আমাদের চায়ের তেষ্টা পাওয়ায় আমাদের গাইড ও বন্ধু বিজনকে বললাম, ‘দাদা চা হলে ভালো হতো। কোথাও কী দোকান-টোকান নেই ? আসার সময় তো চোখে পড়েনি।’ একথা শুনে বিজন বললো, ‘আছে দাদা, আছে, একটা দোকান আছে। নিয়ে যাচ্ছি সেখানে।’ এই বলে কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে গেলাম গহিন বনের ভেতরে রাস্তার পাশেই একটি ঝুপড়ি ঘর।
সেখানে এক গারো মহিলা পাঁকুড়া (সবজির পিয়াজু) ভাঁজছে। সাথে দেখলাম খাঁটি গরুর দুধের চা-ও রয়েছে। ওই মহিলাকে হেল্প করছে আরও দুই গারো মেয়ে। যাই হোক আমরা ওই ঝুপড়ি ঘরে গিয়ে বসে প্রথমে পাঁকুড়া খেলাম এবং পড়ে গরুর দুধের চা পান করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আবারও অন্য গন্তব্যে ছুটে চললাম।
আমরা এসময় ওই গারো নারীদের আতিথিয়তায় মুগ্ধ হলাম। বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে আমাদের কাছ থেকে চা ও পাঁকুড়ার দামও কমিয়ে নেয়। তবে স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রইলো মেঘের উপর ভাসমান ‘নকরেক পার্ক’। সেইসাথে হৃদয়ে দাগ কেটে রইলো কমলা এবং নাসপাতি বাগানের নাসপাতি খাওয়া।
জেবি