সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের আকাশ বেশিরভাগ সময় কালো হয়ে থাকে। এর মূলে রয়েছে ডিজেল চালিত জেনারেটর। বিদ্যুতের জন্য বৈরুতে আট হাজারের মতো জেনারেটর প্রতিদিন চালানো হয়। এর জন্যই বৈরুতের সুউচ্চ ভবনগুলোর ওপরে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয় থাকে। আর এতেই লেবাননের রাজধানীতে বাড়ছে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব।
দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতি নিয়ে ভুগছে লেবানন। অর্থনৈতিক সংকট কাটছেই না। ক্রমে বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে জনমনে বাড়ছে ক্ষোভ। অর্থনৈতিক সংকটের জেরে দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভাটা পড়েছে। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পেয়ে জেনারেটরের দিকে ধাবিত হয়েছে ব্যবসায়ীরা। আর এ জন্যই বৈরুতের প্রতিটি রাস্তায় জেনারেটেরের দেখা মিলে। শোনাও যায় এই যন্ত্রের শব্দ। এ ছাড়া মিলে পোড়া গন্ধও।
ডিজেল চালিত জেনারেটরে বৈরুতের পরিবেশ ব্যাপকহারে দূষিত হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শহরটির বাসিন্দাদের মাঝে। দূষিত বায়ুতেই শ্বাস নিতে বাধ্য হচ্ছে বৈরুতের লোকজন। আর এতেই বাড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমনি তথ্য। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের (এআইবি) বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাটি চালিয়েছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে ডিজেল চালিত জেনারেটরের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা ক্যান্সারের ঝুঁকিকে দ্বিগুণ করেছে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ নির্ণয়ের হার বাড়ছে।
এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন বায়ুমণ্ডলীয় রসায়নবিদ নাজাত সালিবা। তিনি বলেন, প্রতিবেদনের ফলাফল খুবই ভয়ানক। বৈরুতের সবচেয়ে জনাকীর্ণ এলাকা মাকাসেদ। এই এলাকাটির বায়ু পরীক্ষা করে বিস্মিত হয়েছে বিজ্ঞানীরা। সেখানকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে মিলেছে ভাসমান ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটারের কম সূক্ষ্ম কণা। এরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন মানুষকে এমন দূষণে বছরে ৩ থেকে ৫ বারের বেশি সংস্পর্শে আসা উচিত নয়।
২০১৭ সাল সবশেষ বৈরুতের বায়ু পরীক্ষা করেছিল এআইবি। আর গবেষণার পরবর্তী পরীক্ষাটি চালিয়েছে সম্প্রতি। বৈরুতের তিনটি এলাকার বায়ুতে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ কার্সিনোজেনিকের পরিমাণ আগের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে এআইবি। সালিবা বলেন, লেবাননের রাজধানীতে ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এই নারী আরও বলেন, ডিজেল চালিত জেনারেটর কার্সিনোজেনিক বৃদ্ধিতে সরাসরি দায়ী। ডিজেল চালিত জেনারেটর থেকে যে পদার্থগুলো বের হয় সেগুলো ওয়ানএ ক্যাটাগরির কার্সিনোজেনিক।
বৈরুতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে জেনারেটরের প্রভাব অন্যতম। ডিজেল চালিত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়। এমনটা চলে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে।
২০১৯ সালে অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়ে লেবাননের বিদ্যুৎ খাতেও। সংকট শুরুর মাসখানেকের মধ্যেই বিদ্যুৎ খাতের পতন হতে থাকে। এমন সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠে ডিজেল চালিত জেনারেটর। এ ছাড়া ২০২০ সালের আগস্টে বৈরুতের বাণিজ্যিক বন্দরে বিস্ফোরণে দেশটিকে আরও প্রভাবিত করে। ওই বিস্ফোরণে ২০০ এর অধিক মানুষ প্রাণ হারান। কেঁপে উঠে গোটা লেবানন।
বৈরুতের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০২০ সাল থেকে ক্যান্সার বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, এ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট ডেটা নেই।
নিজের স্ত্রী বারবারা নাসারের নামে একটি ক্যান্সার সাপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন চালান হানি নাসার। এই অ্যাসোসিয়েশন ডিম্বাশয় ক্যান্সার আক্রান্তদের সহায়তা করে। তারা সরকারি কোনো সহায়তাও পায় না। লেবাননের ক্যান্সার আক্রান্তরা সবচেয়ে ভয়ানক কিসের মুখোমুখি হন তা জানিয়ে হানি নাসার বলেন, এই সংকট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। পাবলিক সেক্টরের গড় বেতন মাসে প্রায় ১৫০ মার্কিন ডলার। যা কেমোথেরাপির খরচের চেয়ে অনেক কম। তিনি আরও বলেন, আমরা এমন অনেক রোগী পেয়েছি যারা অর্থাভাবে নিজেদের চিকিৎসাও শুরু করতে পারেননি। তারা শুধু বলছে, আমি তো মারায় যাবো। চিকিৎসার জন্য শুধু শুধু অর্থ খরচ করে কি লাভ, পরিবারকে কষ্ট দিয়ে।
২০২৩ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব জনগণের বিদ্যুতের অধিকারকে প্রভাবিত করেছে। ওই প্রতিবেদনে পয়েন্টেড করে বলা হয়, লেবানন সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের দিকেই ঝুঁকছে। যেখানে অন্যদেশগুলোর সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ডিজেল আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এই কোম্পানিগুলির শেয়ারহোল্ডার ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে।
সালিবা বলেন, জেনারেটরের মালিক ও জ্বালানি আমদানিকারকরা ডিজেল পুড়িয়ে শহরের মানুষকে মারছে। তারা সঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। ২০১৭ সালে লেবানন ৯০ কোটি মার্কিন ডলারের জ্বালানি আমদানি করে। ২০২২ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৯০ কোটি ডলারে।
২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ু দূষণের জেরে ২০১৮ সালে লেবাননে দুই হাজার ৭০০ মানুষ অকালে প্রাণ হারান। ওই বছরটিতে বায়ু দূষণে মৃত্যুর দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে ছিল লেবানন। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণের জন্য লেবাননের অর্থনীতির ক্ষতি হয় ১৪০ কোটি ডলারের। যা দেশটির জিডিপির দুই শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল চালিত জেনারেটর যেভাবে লেবাননের ক্ষতি করছে তেমনটি করছে সিগারেটও। অনুমান করা হয়, লেবাননের মোট প্রাপ্ত বয়স্কের ৭০ শতাংশ প্রতিদিনই ধূমপান করেন। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ চেইন স্মোকার।
এম