সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
শরীয়তপুরে অর্থের অভাবে পড়াশোনা বন্ধের পথে অলরাউন্ডার খাদিজা আক্তারের। খাদিজার বয়স এখন ১৮ ছুঁইছুঁই। ১২ বছর আগে তার বাবা মারা গেছে। পেটের দায়ে খাদিজাকে নিরানীর কাজ করতে হয় অন্যের ফসলি জমিতে। মাকে নিয়ে খাদিজা থাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে। কিন্তু ঘরটিও তাদের নয়। ফসলি জমিতে নিরানীর কাজ করলে মা ও মেয়ের আহার জোটে, না করলে উপোস থাকতে হয় তাদের। কিন্তু জেলা ও জেলার বাইরে ক্রিকেট খেলায় অলরাউন্ডার খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত খাদিজা।
স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজার মানবেতর জীবনের এই সংগ্রাম সরাসরি যে না দেখেছে, তার কাছে কথাগুলো গল্প মনে হবে হয়তো। খাদিজা শরীয়তপুর সদর উপজেলার তুলাসার ইউনিয়নের রঙের বাজার সংলগ্ন রাজ্জাক খলিফার বাড়ির সামনের একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে বোন সাহিদা আক্তারের সঙ্গে থাকে। সে সদর উপজেলার উপরগাঁও এলাকার কীর্তিনাশা নদীর পাড়ের বাসিন্দা মৃত সিরাজ শেখ ও সালেহা বেগম দম্পত্তির ছোট মেয়ে খাদিজা আক্তার।
জানা গেছে, এক যুগ আগে চার মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে মারা যান রিকশা গ্যারেজের শ্রমিক সিরাজ শেখ। আধা শতাংশ জমির ওপর ছোট্ট একটি খুপড়ি ঘর ছাড়া ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি সিরাজ শেখ। ৬ বছর বয়স থেকে অন্য ভাই-বোনদের সঙ্গে শুরু হয় খাদিজার জীবন সংগ্রাম। অন্যের ফসলি জমিতে নিরানীসহ বিভিন্ন কাজ করে সংসার ও পড়াশোনা ভালোই চলছিল খাদিজার। বড় ভাই-বোনেরা বিয়ে করলেও মাঝে মধ্যে খাদিজা ও তার মাকে সহযোগিতা করত।
কিন্তু কয়েক বছর ধরে খাদিজার বড় বোন মঞ্জিলা বেগমের স্বামী রাজমিস্ত্রী সহকারী সালাম বেপারী ভবন থেকে পড়ে গিয়ে এখন অসুস্থ। মেঝো বোন সাহিদা বেগম আগুনে পুড়ে গিয়ে অসুস্থ। তার স্বামী রুবেল ব্যাপারী ক্যানসার আক্রান্ত। সেঝো বোন পিংকি আক্তারের পাকস্থলী ছিদ্র হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। ভাই মিরাজ শেখ পেশায় একজন অটোরিকশাচালক। তিনি তার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে আংগারিয়াতে ভাড়া থাকেন।
খাদিজা আক্তারের মা সালেহা বেগম বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। সাংসারের খরচ, মায়ের ওষুধ, নিজের পড়াশোনা সব কিছুর ব্যয়ভার খাদিজা আক্তারের বহন করতে হয়। খাদিজা অন্যের ফসলি জমির নিরানীসহ বিভিন্ন কৃষিকাজ করে উপার্জন করেন। কঠোর পরিশ্রমের এসব কাজ করেও খাদিজা পড়াশোনা ছেড়ে দেননি কখনও।
হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে শরীয়তপুর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের প্র্যাকটিস করেন। খাদিজা নারী ক্রিকেট দল শরীয়তপুরের হয়ে ঢাকা, রংপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিজয় অর্জন করেছে। পরিবারের অর্থাভাবে এখন আর খাদিজা আক্তার ক্রিকেট প্রাকটিস করেন না। শরীয়তপুরের আংগারিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য ওই কলেজেই খাদিজা ভর্তির আবেদন করছেন।
গত ৫ সেপ্টেম্বর অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে গেলে হাসপাতালের সিঁড়ির নিচ থেকে খাদিজা আক্তারের সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। খাদিজা আক্তার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চোর শনাক্ত করে সাইকেলটি উদ্ধারের জন্য। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার কথায় সায় দেয়নি। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, পরিবারের খরচ, কলেজের ভর্তি ফি, বইপত্র কেনার অর্থ, কীভাবে কলেজে যাবে সে, এসব চিন্তায় খাদিজা আক্তারের দিন কাটে এখন।
ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আকলিমা বেগম বলেন, খাদিজা আক্তারের জীবন সংগ্রাম অন্যরকম। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা থাকেন তারা সবাই গরিব। কিন্তু খাদিজাদের মত গরিব আর একজনও নেই। অন্যের ফসলি জমিতে কাজসহ অনেক কষ্ট করে মেয়েটা। এত কিছুর মধ্যেও সে পড়াশোনা করে। খাদিজা কাজ করলে তাদের চুলায় আগুন জ্বলে, কাজ না করলে চুলা বন্ধ থাকে।
খাদিজা আক্তারের মা সালেহা বেগম বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি কষ্ট করে। সেই ছেলে-মেয়েরা এখন অসুস্থ বলে আমার ভরণপোষণ দিতে পারে না। খাদিজাই কষ্ট করে চাল-ডাল কিনে আনলে রান্না করে দুজনে খেতে পারি। আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট করে। যদি কেউ আমাদের সাহায্য করত, তাহলে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম।
খাদিজা আক্তার বলেন, ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর কাজ করা শুরু করেছি। আগে বোন ও ভাই সংসারে কিছু টাকা দিত। এখন তারাই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত, আমাদের দেবে কীভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ যে আমার বোনকে তিনি ঘর দিয়েছেন। বোনটা যদি তার ঘরে থাকতে না দিত, তাহলে ওই খুপড়ি ঘরে থাকতে হত। বৃষ্টি এলে ওই ঘরে পানি পড়ে বইপত্র, সার্টিফিকেট ভিজে যেত। আমার পরিবারের সবাই অসুস্থ। অসুস্থ মা ও আমার খরচ আমাকেই বহন করতে হয়। যদি কেউ আমার মায়ের চিকিৎসা করিয়ে দিত, আমাকে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি দিত। তাহলে আমি পড়াশোনা ঠিকভাবে করতে পারতাম, ক্রিকেটে আবার প্রাকটিস করতে পারতাম।
শরীয়তপুরের বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ স্টেডিয়ামের কোচ সেলিম শিকদার বলেন, খাদিজা আক্তার একসময় ক্রিকেট প্রাকটিস করত। বেশ ভালোই খেলত মেয়েটা। কিন্তু পরিবারের অর্থাভাবে এখন আর মাঠে আসে না। খাদিজা ক্রিকেটে ভালো করত বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু সবই নিয়তি এখন।
শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, খাদিজা আক্তারের সংগ্রামের কথা শুনেছি আমি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে তাকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি সাইকেল কিনে দেওয়া হবে। এছাড়া তার পড়াশোনা, মায়ের চিকিৎসাসহ তার পরিবারের পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।
এইউ