সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
ফরিদপুর শহরতলীর কানাইপুরের বাসিন্দা খায়রুজ্জামান খাজা (৩৮)। যিনি নিজ নামে এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘খাজা বাহিনী’। বিভিন্ন সময়ে যার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও মুখ খুলতে সাহস পায়নি সাধারণ মানুষ। নিরবে-নিভূতেই কেঁদেছেন তারা। গত ৫ আগস্টের পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে খাজা ও তার বাহিনী। ভাই ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কাউকেই তোয়াক্কা করেননি খায়রুজ্জামান খাজা। সর্বশেষ তুলে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে প্রাণ কেড়ে নেয় ওবায়দুর খান (২৯) নামে এক যুবকের। এরপর থেকেই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন অত্যাচারিত মানুষগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খায়রুজ্জামান খাজা জেলার সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের ভাটী লক্ষ্মীপুর গ্রামের হানিফ মাতুব্বরের ছেলে। তার বড় ভাই বর্তমান ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মুহাম্মদ আলতাফ হুসাইন। খাজার বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দস্যুতাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একাধিকবার আগ্নেয়াস্ত্র, ইয়াবা, দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হলেও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জামিনে বের হয়ে আসেন। এরপর পুনরায় শুরু করে ত্রাসের রাজত্ব।
বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় খায়রুজ্জামান খাজা। তৎকালীন র্যাব-৮ এর ফরিদপুর ক্যাম্পের উপ-অধিনায়ক মেজর আবদুল্লাহ আল হাসান জানান, রাতে হাইওয়ে সড়কে বাসে ডাকাতির প্রস্তুতির সময় খাজাকে আটক করা হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ১৫ মে দুইজন সহযোগীসহ কোতয়ালী থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
তৎকালীন সময়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা জানান, তার বিরুদ্ধে কানাইপুর ইউপিসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দস্যুতা, ভূমি দখলসহ নানা বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চাঁদাবাজি, ডাকাতি, দস্যুতাসহ ১৮টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন।
এরপর ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়া একই বছরে তৎকালীন ফরিদপুর পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান অন্যত্র বদলির পরেরদিন এলাকায় ছাত্রলীগের বিভক্তিকরণে সহযোগিদের নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেন। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরেই ২৮ আগস্ট দেশীয় অস্ত্রসহ খাজা ও তার ৪ সহযোগিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু বারবার গ্রেপ্তার হওয়ার পরেই ক্ষমতার দাপটে জামিনে বের হয়ে আসেন।
কানাইপুরে যুবলীগ নেতা পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে ব্যানার ও ফেস্টুন টানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে নিজেকে জানান দিতেন। এরপর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলা বিএনপির শীর্ষ এক নেতার সমর্থক পরিচয় দিয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। গত ১৮ ডিসেম্বর যুবদল নেতার ব্যানারে মিছিল দিয়ে নিজেকে যুবদল নেতা হিসেবে জাহির করেন। শুরু করেন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে উঠেন। তার দলে না ভিড়ালে জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা না দিলে ছাড়তে হয় এলাকা। এভাবেই গত কয়েকদিনে অন্ততপক্ষে কোটি টাকার চাঁদাবাজি করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক রাজনৈতিক ব্যক্তি জানান।
সর্বশেষ তার হাতে বলি হয়েছেন ওই ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের বিল্লাল খানের ছোট ছেলে ওবায়দুর খান। গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) কানাইপুর মমতাজ ফিলিং স্টেশনে মোটরসাইকেলের তেল কিনতে গিয়েছিলেন ওবায়দুর। সেখান থেকে খায়রুজ্জামান খাজার নেতৃত্বে ১০ থেকে ১৫ জন যুবক ওবায়দুরকে মারধর করে তুলে নিয়ে যান। এরপর ফরিদপুর জুট ফাইবার্সের পেছনে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। তখন ওবায়দুরের দুই চোখে লোহার পেরেক দিয়ে খোঁচানো হয় এবং বাম পায়ের রগ কেটে ভেঙে ফেলা হয়। এরপর রাতে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। এ ঘটনায় শনিবার (১১ জানুয়ারি) রাতে খাজাকে প্রধান আসামি করে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে কোতয়ালী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের মা রেখা বেগম।
নিহত ওবায়দুরের বাবা বিল্লাল খান বলেন, আমার ছেলেকে তুইল্যা নিয়ে মাইর্যা ফেলায়ছে। আমি এই হত্যার বিচার চায়। ওর (খাজা) ফাঁসি না হলে আরও মানুষ মরবে।
নিহতের বড় ভাই রাজিব খান বলেন, খাজার বিভিন্ন অপকর্ম দেখে আমার ভাই প্রতিবাদ জানাতো। এ কারণে আমার ভাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যা করেছে। এর পূর্বেও আমার ভাইকে পাঁচবার দাবড়িয়েছিল। কিন্তু তার ভাই চেয়ারম্যানকে বলা হলেও কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।
এদিকে, ওবায়দুর হত্যার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, গত ৫ই আগস্টের পর থেকে খাজাকে টাকা দিয়ে এলাকায় থাকতে হয়েছে। কেউ টাকা না দিলে তাকে ভয়ভীতি ও মারধর করা হতো।
কোশাগোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা লাবলু মোল্যা অভিযোগ করে বলেন, আমাকে তার দলে যোগ দিতে বলে। যোগ না দেওয়ায় আমাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে খাজা। টাকা না দিলে আমাকে হুমকি দিয়ে বলে, টাকা না দিলে তোমার জমিজমা বিক্রি করে টাকা নেব। এমনকি মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। আজকে যেমন ওবায়দুরকে মেরে ফেলেছে কাল আমাকেও মেরে ফেলতে পারে। এই খাজার কারণে কানাইপুরের একজন মানুষও সুস্থভাবে রাতে ঘুমাতে পারতেছে না।
এ বিষয়ে কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদউজ্জামান জানান, খাজাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শিগগিরিই তাকে গ্রেপ্তার করে জানানো হবে। এছাড়া ওবায়দুর হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত রেজাউল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরএ