সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ। রাস্তার দু’ধারে গারো আর খাসিয়া পাহাড়জুড়ে মেঘ রাজ্যের মেঘদের ছোটাছুটি-লুটোপুটি খেলা। শিলংয়ের এ পথেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় অমিত আর লাবণ্যের গাড়ি। তারপর তাদের পরিচয়। অমিত-লাবণ্য মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র অমিত-লাবণ্য। মূলত ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির প্রেক্ষাপটেই লেখা উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’। এছাড়া শিলংয়ের নানা বর্ণনাও পাওয়া যায় শেষের কবিতায়। বলা যায়, শেষের কবিতার শুরুটা এ শিলংয়েই।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭ সালে তিন দফায় ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী শিলং গিয়েছিলেন। প্রথমবার তিনি ছিলেন উম শিরপির ঝর্ণার পাশে কে সি দে’র ব্রুকসাইড বাংলোয়। দ্বিতীয়বার তিনি ওঠেন জিৎ ভূমিতে এবং শেষবার তিনি ছিলেন লাইতুমখারার আপল্যান্ডস-এ সলোমন ভিলা বা সিধলি প্যালেসে। পাইন আর দেবদারু বাগানঘেরা এ জিৎভূমি বাড়িতে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতা ছাড়াও ‘একটি ছাউনি, একটি দিন’ লেখেন। এছাড়া তিনি কিছু অনুবাদও করেন এখানে থেকে।
শিলংয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনেক স্মৃতি। সেসব স্মৃতির খোঁজেই ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে মেঘালয় ভ্রমণের প্রথম দিনই হাজির হই শিলংয়ের রিলবংয়ের জিৎভূমি বাড়ির সামনে। এর আগেও আরেকবার যাওয়া হয়েছিল শিলংয়ে। কিন্তু তখন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির খবরটি জানা ছিল না আমার। এছাড়া আগেরবারের ভ্রমণটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। তবে এবার পরিবার নিয়ে ভ্রমণে বের হওয়ায় আগে থেকেই শিলং দর্শনের বিভিন্ন তথ্য জেনে বের হই।
২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট ভ্রমণে আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী, ছোট ছেলে এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওইদিন সকালে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও-ডালু বর্ডার হয়ে সীমান্তের বারাঙ্গাপাড়া বাজার থেকে আসামের গুয়াহাটির নাইট বাস ধরে ভোর রাতে প্রথম গুয়াহাটি পৌঁছাই আমরা। পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত গুয়াহাটি সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি দিয়ে শিলংয়ের পর্যটক এলাকা পুলিশ বাজার পৌঁছাই বেলা ১২টার দিকে। সেখানে পূর্ব পরিচিত ‘পাইন বোরো’ হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ভ্রমণের প্রথমদিনের সফর হিসেবে শহরের ৭টি সাইট ভিউ দেখার উদ্দেশে একটি ট্যাক্সি কার ভাড়া করি।
এরপর প্রথমেই চলে যাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়িটিতে। সাথে ছিলেন আমার স্ত্রী রত্না, ৬ বছর বয়সী শিশুপুত্র রাফসান এবং আমার এক সাংবাদিক বন্ধু কাজি মাসুম। শিলংয়ের পুলিশ বাজারের অনেকটা কাছেই এ বাড়ি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের রবীন্দ্রনাথের ওই বাড়িটি এখন ‘রবীন্দ্রনাথ আর্ট গ্যালারি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় গ্যালারিটি শনি ও রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে। ফলে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত ও ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র, কবিতাসহ অন্যান্য তথ্য দেখা ও জানা হলো না।
তবে বাড়ির বাইরের অংশে রবীন্দ্রনাথ যেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতেন সেই ছায়াঘেরা দেবদারু গাছ, বাড়ির আঙিনায় তার পায়চারীর স্থানগুলোতে কিছুক্ষণ নীরবে ঘোরাফেরা করি আর ভাবি কোনো একদিন এ বাড়িতে কবিগুরু থেকেছেন, বাড়ির এই আঙিনায় হেঁটেছেন, কিংবা বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসেছেন। কিন্তু আফসোস, কবির সেই পদচিহ্ন ও ব্যবহৃত আসবাবপত্র আমরা দেখতে পেলাম না। তবে সেই পুরোনো স্মৃতিময় টিনশেড ঘরটির চালের দিকে তাকালেই যেন রবি ঠাকুরের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে।
ঘরের প্রধান ফটকে তালা ঝোলানো থাকলেও সেখানে গিয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতরের কোনো দৃশ্য দেখা যায় কিনা তা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। সেসময় কোনো কেয়ার টেকারকেও চোখে পড়ল না। প্যালেসের প্রধান ফটকও খোলা ছিল। তাই আমরা সহজেই বাড়ির ভেতর ঢুকে নিজেরাই ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি এদিক-ওদিক। তবে আমি এবং আমার স্ত্রী রবি ঠাকুরের সেই অমিত-লাবণ্যের মতো সেখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এবং আশপাশে ঘুরে দেবদারু আর পাইন গাছের বাতাসে রবি ঠাকুরের স্মৃতির পরশ ও অনুভূতি নেওয়ার চেষ্টা করলাম। দু’জন দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবিও তুললাম রবি ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটির বিভিন্ন স্থানে। এখনও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছের তলে দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরের স্মরণে একটি কবিতাও রচনা করলাম আমি। কবিতাটা হলো-
মেঘালয়ে রবি ঠাকুর
শত বছর আগে এসেছিলেন কবি
প্রকৃতির টানে এ মেঘের দেশে।
ঝর্ণার জল-মেঘের জলরাশির ছোঁয়ায়
লিখেছেন তিনি আপন বেশে।
অমিত-লাবণ্যকে করে রখেছেন স্মৃতি
এ মেঘ-পাহাড়ি বন ভূমিতে।
শেষের কবিতা উপন্যাসের পাতার
প্রতিটি পরতে পরতে।
সেই কাঠের থাম, টিনের চাল
আছে সব ঠিকঠাক
ঘরের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে
রবি ঠাকুর, নির্বাক।
নেই আজ অমিত-লাবণ্যে
আছে শুধুই অতীত স্মৃতি
তবুও গায় গান পবন জোয়ারে
দেবদারুর ছায়া বীথি।
রবীন্দ্রনাথ শিলংয়ে প্রথমবার এসে এখানেই থাকেন তিন সপ্তাহের মতো। আর্ট গ্যালারির সামনেই আছে কবিগুরুর পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য। প্রায় ২৫ ফুট উঁচু সে ভাস্কর্যের ভঙ্গিমা দেখে মনে হয় সত্যি সত্যিই রবি ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের সামনে। ২০১১ সালে এ ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। শিলংয়ে মূলত খাসিয়া ও গারোদের আবাসস্থল বিধায় সেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতা এসব বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ভাষাগত কারণে তারা খুব বেশি স্মরণও করে না রবি ঠাকুরকে।
স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে চেনেই না অনেকে। যারা নাম শুনেছে তারা অবাঙালি হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ তথা বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে সেই আর্ট গ্যালারিতে স্থানীয়দের পদচারণা নেই বললেই চলে। যারা আসেন তাদের বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আর বাংলাদেশের পর্যটক। শিলংয়ে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত আরেকটি বাড়ি লাইতুমখারার আপল্যান্ডসের সলোমন ভিলা বা সিধলি প্যালেস। বেশ কয়েক বছর আগেই এ প্যালেস ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি ভবন। সেখানের রবি ঠাকুরের কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যাবে না বিধায় আমরা আর সেদিক গেলাম না। এরপর চলে যাই আমাদের পরবর্তী ভ্রমণ তালিকায়।
ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আসার সময় নয়নাভিরাম ও রোমাঞ্চকর নানা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং ভালো লাগার মুহূর্তগুলোর পাশপাশি রবি ঠাকুরের বাড়িটিও বেশ স্মরণীয় হয়ে আছে আমার জীবনে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখালেখিতে ঝোঁক থাকায় অনুভূতিতে রবি ঠাকুরের স্মৃতিময় বাড়ি ও সেখানকার আলো-বাতাস চিরদিন আমার মনে গেঁথে থাকবে। রবি ঠাকুরকে দেখার সৌভাগ্য না হলেও তার স্মৃতিময় স্থানে ভ্রমণ করাটাও আমাকে বেশ পুলকিত করেছে, মনকে তৃপ্ত করেছে বিশ্বকবি এবং কবিগুরুর স্মৃতিময় পরশ মণিকোঠায় রেখে দিতে পারায়।
আবার কোনোদিন সময় ও সুযোগ হলে সেই বাড়ির ভেতরে রাখা রবি ঠাকুরের ব্যবহারের সামগ্রী দেখে মনের অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করব। তাই ভ্রমণপিপাসু বন্ধুরা শিলং গেলে শিলংয়ের মেঘ-বৃষ্টির খেলা দেখার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের নটরাজ রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দেখতে ভুল করবেন না।
মন্তব্য করুন