দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
ভিলেজ পলিটিক্স। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ এই শব্দগুচ্ছের সঙ্গে বহুল পরিচিত। এই গ্রাম্য রাজনীতির ফাঁদে পড়ে অনেক লোক নিঃস্ব হয়েছেন। সীমাহীন হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছেন অনেকেই। ভিলেজ পলিটিক্সে লাশ নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় নতুন ঘটনা নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে রক্ত আর লাশের রাজনীতি এবং প্রতিপক্ষ দমনে লাশের ব্যবহার হয়ে আসছে। ফ্যাসিস্ট এই স্টাইল এখনো বহাল। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নে মাদক উদ্ধারকারি সংস্থার সোর্স আব্দুল হাকিম পিন্টু হত্যাকাণ্ড নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড এখন আওয়ামী লীগ নেতা ওমর আলী ও চরবাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শাহিদ রানা টিপুর খেলাই পরিণত হয়েছে। ভিলেজ পলিটিক্সের প্রভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নিহত পিন্টুর পরিবার। নিহতের বাবা, ভাই ও বোন বলছেন ইউপি চেয়ারম্যান শাহিদ রানা টিপু ও তার লোকজন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অপরদিকে নিহতের স্ত্রী সন্তানরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতা ওমর আলী, তাঁতী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম ও জুয়েল পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
জানা গেছে, গত ১২ই জানুয়ারি হামলার শিকার হন আব্দুল হাকিম পিন্টু। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৩শে জানুয়ারি মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনায় চরবাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শাহীদ রানা টিপুকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন নিহতের বাবা মো. হুমায়ুন। তবে মাস না পেরোতেই বিভক্ত হয়ে পড়ে নিহত পিন্টুর পরিবার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন চরবাগডাঙ্গা এখন দেশের মাদক কারবারের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সীমান্তপথে আসছে বিপুল পরিমাণ মাদক। এর মধ্যে ইয়াবা ও হেরোইনের সবচেয়ে বড় চালানগুলো আসছে এই পথে। চরবাগডাঙ্গা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। অসংখ্য গডফাদারের বসবাস এই ইউনিয়নে। জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই মাদক কারবারে জড়িত। মাদক উদ্ধারকারি সংস্থাকে তথ্যদিয়ে অনেক মাদক কারবারিকে জেলে পাঠান নিহত পিন্টু। এ কারণে দীর্ঘদিনধরে তার জীবন শঙ্কায় ছিল। তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই সুযোগে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন পিন্টু।
গত ২রা মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে পিন্টুর স্ত্রী ও সন্তানরা। পিন্টুর স্ত্রী পারভিন বেগম অভিযোগ করে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর আওয়ামী লীগ নেতা ওমর আলী, সদর উপজেলা তাঁতী লীগের সভাপতি মাদকের গডফাদার নুরুল ইসলাম ও মাদক সম্রাট জুয়েল রানা পরিকল্পিতভাবে তার স্বামীকে নির্মমভাবে খুন করেছে। এখন তার শ্বশুর হুমায়ুন ও ননদ জান্নাতুন স্বামীর লাশ নিয়ে ব্যবসা করেছে। মাদক সিন্ডিকেটের কাছে ৩০ লাখ টাকায় লাশ বিক্রি করে তাদের কথামতো প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে।
৩ মার্চ স্বামী হত্যার ঘটনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে মামলাও করেছেন পারভিন বেগম। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে চরবাগডাঙ্গা ইউপি সদস্য মো. জুয়েল রানাকে। অন্য আসামিরা হলেন, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ওমর আলী, ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম, মতিউর রহমান, মানিক আলী, নাজমুল হক গুধা, মো. সুমন, জাহাঙ্গীর আলী, ইসমাইল হোসেন ও মোশাররফ হোসেন মুসা। আসামিরা সবাই চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা।
এরপর গত ৯ই মার্চ নিহত পিন্টুর বাবা, ভাই ও বোন মানববন্ধনের আয়োজন করেন। ওই মানববন্ধনে পিন্টুর স্ত্রী-সন্তানরা ছিলেন না। মানববন্ধনে দেওয়া বক্তব্যে পিন্টুর বোন জান্নাতুন তার ভাবির (নিহতের স্ত্রী) বিরুদ্ধে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন। ওই হত্যা মামলার এজাহার নামীয় আসামির সঙ্গে ৫ বছরের পরকীয়া সম্পর্কেরও অভিযোগ করেন তিনি।
নিহতের মা, ভাই ও বোনের কয়েকটি অডিও রেকর্ড হাতে এসেছে এ প্রতিবেদকের। অডিও রেকর্ড পর্যালোচনায় লাশ নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসার প্রমাণ মিলেছে। ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডে নিহতের বোন ও হত্যা মামলার স্বাক্ষী জান্নাতুনকে বলতে শোনা যাচ্ছে, এতদিনে তিনি বুঝতে পেরেছেন কারা তার ভাইয়ের আসল খুনি। এ কারণে তিনি রাজশাহী বা গোদাগাড়ীতে গিয়ে গোপনে ভাই হত্যা মামলার প্রধান আসামি চেয়ারম্যান টিপুর সঙ্গে দেখা করেত চান। এবং মামলার আসামি করার জন্য ভূল স্বীকার করে চেয়ারম্যানের কাছে বিচার চাইবেন।
আরেকটি অডিও রেকর্ডে দেখা গেছে নিহত পিন্টুর মেয়ে সীমাকে তার বাবা হত্যা বিচার দাবিতে হওয়া মানববন্ধনে যাওয়ার জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা এবং পরে ৩০ লাখ টাকার প্রলোভন দেয়া হচ্ছে। সীমার দাদি (নিহত পিন্টুর মা) তাকে এই প্রলোভন দিচ্ছেন। একই রেকর্ডে তার চাচা ভাতিজি সীমাকে তার স্বামীকে বিদেশ পাঠানোর জন্য যত টাকা দরকার তারা দিবেন। কিন্তু প্রলোভনে কোন লাভ হয়নি। নিহতের মেয়ে ওই মানববন্ধনে যাননি।
ইউপি চেয়ারম্যান টিপুর অনুসারিরা বলছেন, পিন্টুর বোনের কল রেকর্ডে এটা পরিষ্কার কারা তাদের ইন্ধন দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে মামলায় জড়িয়েছে। বাবার হত্যার বিচার দাবিতে হওয়া মানবন্ধনে যাওয়া জন্য কারা তার মেয়েকে ৩০ লাখ টাকা দিবে, কেন দিবে। এসব প্রশ্নের উত্তরে পিন্টুর হত্যাকারিদের খুঁজে পাওয়া যাবে। তারা বলছেন, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হলে আসল খুনিরা বেরিয়ে আসবে।
ইউপি চেয়ারম্যান শাহিদ রানা টিপুর সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলার আসামি হওয়ার কারণ জানতে তিনি বলেন, আমি কারও অন্যায় নির্দেশ না মানায় আমাকে হয়রানি করতে মামলায় জড়ানো হয়েছে। ঘটনাটি সঠিক তদন্ত হলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চরবাগডাঙা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ওমর আলী বলেন,পিন্টু হত্যাকান্ডে আমার কোন সংশ্লিষ্ঠতা নাই,অন্যায়ভাবে আমাকে জড়ানো হচ্ছে। তবে মানববন্ধন আয়োজনে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,সবাই গেছে,তাই আমিও গেছিলাম।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান বলেন,মামলাটির প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে যা যা করণীয় সব করছে পুলিশ। এই মামলায় নিরপরাধ কাউকে হয়রানী করা হবে না।
এফএইচ/