সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
মোটা অঙ্কের টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে জন্ম নিবন্ধন। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে এসব জন্ম নিবন্ধন চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গাসহ অপরাধীদের হাতে। তৈরি হচ্ছে পাসপোর্টও। বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে রোহিঙ্গারা। আর এসব অপকর্মে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও তাদের সচিবরা এতে জড়িত।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি বিরাট অংশ অসাধু চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা তৈরি করছে নকল জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র। এসব নকল কাগজপত্র ব্যবহার করে সহজেই মিলছে পাসপোর্ট। তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ইউপি সচিব ও চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় কয়েকজন রোহিঙ্গা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করেন বলে জানা যায়।
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে চলতি বছরের ১১ জুন ভিয়েতনামে যাওয়ার চেষ্টা করেন হুমায়রা ও শারমিন আক্তার নামে দুজন রোহিঙ্গা। তবে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের সন্দেহ হলে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। পরে অনুসন্ধানে বের হয়, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ইউপি সচিবের সহযোগিতায় তারা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করেন।
ওই ঘটনার চার দিন পর কুমিল্লা জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) উপপরিদর্শক (এসআই) ইমাম হোসেন বাদী হয়ে চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই আলমগীর হোসেন। তদন্তের শুরুতে গত ২৭ জুন হুমায়রা ও শারমিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
এরপরই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। বিভিন্ন সূত্রে ধরে এই ঘটনার মূল বের করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ওই দুই নারী কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে ভিয়েতনামে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সেটা বের হয়ে আসে। তারা চৌদ্দগ্রামের চিওড়া ইউনিয়নের ডিমাতলী গ্রামের বাসিন্দা কাজী খবীর উদ্দিনের মেয়ে পরিচয়ে তৈরি করেন ভুয়া জন্মসনদ। চিওড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সচিব রুহুল আমিন মজুমদার মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাদের জন্ম সনদ পেতে সহযোগিতা করেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ডিমাতলী গ্রামের বাসিন্দা কাজী খবীর উদ্দিন ও চিওড়া ইউপির সচিব রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ভুয়া জন্ম সনদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের জন্ম সনদ তৈরি করে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র ও বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরিতেও সহায়তা করে সিন্ডিকেটটি।
সূত্র আরও জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া রোহিঙ্গা আইডি কার্ড অনুযায়ী, হুমায়রার বাবার নাম সামসু আলম। আর শারমিনের বাবার নাম নুর কামাল। অথচ গত বছরের ১০ ডিসেম্বর হুমায়রার নাম পরিবর্তন করে মাইমুনা আক্তার নাম দিয়ে নিজের মেয়ে দাবি করে চিওড়া ইউপি থেকে একটি জন্ম সনদ তৈরি করেন কাজী খবীর উদ্দিন। একইভাবে শারমিন আক্তারকেও নিজের মেয়ে দাবি করে আরও একটি জন্ম সনদ তৈরি করেন তিনি।
শুধু হুমায়রা ও শারমিনই নয়, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে আরও বেশ কয়েকটি ভুয়া জন্ম সনদ বানানোর তথ্য। এছাড়াও টাকার বিনিমিয়ে দ্বৈত জন্ম সনদও তৈরি হয় এই ইউনিয়ন পরিষদে। ইউপি চেয়ারম্যানের আইডি ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরেই এসব অপকর্ম চলে আসছে এই পরিষদে।
এর আগেও জন্ম নিবন্ধনে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সচিব রুহুলের আইডিটি একাধিকবার বন্ধ রেখেছিল। মুচলেকা দিয়ে তিনি আইডিটি ফিরে পান। এ ছাড়া রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানদের স্বাক্ষর জাল করে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা প্রতিবেদককে বলেন, সচিবের কাছে জন্ম সনদ করতে গেলেই ৩/৪ হাজার টাকা চায়। এছাড়াও, ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে সবকিছুতেই অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। চেয়ারম্যানের আইডি সচিব কিভাবে ব্যবহার করে। দুইজনে মিলেই এগুলো করছে। আমরা এর নিস্তার চাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি সচিব রুহুল আমিন মজুমদার বলেন, ‘কাজী খবীর উদ্দিন ও তার স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র এবং মেয়ে মাইমুনা আক্তারের এসএসসির প্রবেশপত্র অনুযায়ী জন্ম সনদ দেওয়া হয়েছে। সে রোহিঙ্গা নারী কি না, আমার জানা নেই।’
এ বিষয়ে চিওড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের বলেন, আমি অনলাইনে অজ্ঞ থাকায় আমার আইডি সচিবকে দিয়ে রেখেছি। সে কি করে না করে, আমি জানি না। আমি শুধু স্বাক্ষর করি। তাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল হয়েছে। আমি এই বিষয়ে অভিযোগও করেছিলাম।
তবে কাজী খবীর উদ্দিন পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি ত্রিনাথ সাহা বলেন, দালালচক্রের এক সদস্যসহ দুই রোহিঙ্গা নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তে যারা দোষী হবেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘চিওড়া ইউপি সচিব রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দিচ্ছে—এমন অভিযোগ আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরএ