সম্পাদক: আরিফ হাসান
দেশ টেলিভিশন লিমিটেড, কর্ণফুলী মিডিয়া পয়েন্ট, ৪২, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭, বাংলাদেশ।
টেলিফোন: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৫৮, ৮৩৩২৯২২ ফ্যাক্স: +৮৮ (০২) ৮৩৩২৯৮১ মেইল: [email protected]
সোমবার (৮ জুলাই) নাসরিন ট্রাজেডি। ২১ বছর আগে এই দিনে ভোলার ইতিহাসে ভয়াবহ এক লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এই দিন ঢাকা থেকে লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ চাঁদপুরের ডাকাতিয়া এলাকায় যাত্রী নিয়ে মেঘনা নদীতে ডুবে যায়। এতে প্রাণ হারায় জেলার তিন উপজেলার অন্তত ৪ শতাধিক মানুষ।
ওই দুর্ঘটনার পর থেকে এক এক করে পেরিয়ে গেছে ২১ বছর। সেই দুর্ঘটনায় কেউ হারিয়েছে বাবা। আবার কেউবা পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে। মর্মান্তিক সেই স্বজনহারা মানুষের কান্না যেন আজো থামেনি।
সেই দুর্বিশহ স্মৃতি কথা মনে আজো আঁতকে উঠেন স্বজনহারা মানুষ। দুর্ঘটনা অনেকেই স্বপরিবারে মারা যান। কেউ বা পরিবার এক বা একাধিক স্বজন হারান। বেশিরভাগ মানুষের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রিয়জনরা ফিরে আসবেন এমন প্রতিক্ষায় এখনও অনেকেই রয়েছেন। স্বজন হারানোর পর পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু স্বজনহারা ক্ষত আজো কাঁদায় তাদের।
ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের গজারিয়া বাজার সংলগ্ন বেপারি বাড়ির বশির উদ্দিন বেপারি পেশায় বাসচালক ছিলেন। চাকরি খোঁজে তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন। দুর্ঘটনার কবলিত সেই লঞ্চের যাত্রীও ছিলেন। সেদিন তিনিও ফিরছিলেন নিজের গ্রামের বাড়ি লালমোহনে।
কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি নিখোঁজ। তার লাশ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ বশিরের পরিবারের সদস্য তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছেন। কিন্তু তার লাশ খুঁজে পাননি। ছেলে মাহফুজের বয়স তখন ৬ মাস। বাবার আদর-স্নেহ পাননি। এখন তার বয়স ২০ বছর।
কান্নাজড়িত কন্ঠে মাহফুজ জানায়, কোনোদিন বাবার আদর ভালোবাসা পাইনি। বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবার অভাব কোনোদিন পূরণ হবার নয়।
বশির বেপারীর স্ত্রী নাহার বেগম জানান, ছেলেদের-মেয়ের অনেক কষ্ট করে বড় করে তুলেছি, দুর্ঘটনার পর থেকে কেউ আমাদের খবর নেয়নি। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় সে ফিরে আসবে। তার ফিরে আসার অপক্ষোয় আছি এখনও। যদি ভাগ্যে থাকে তো ফিরে আসবে।
নাহার বেগম বলেন, ঢাকা থেকে ফোন দিয়েছিল, বলেছিল, বাসায় ফিরে বাজার করবেন। ছেলেদের তখন পরীক্ষা চলছিল। আমার তিন ছেলে-মেয়ে তখন কিন্ডার গার্টেনে পড়াশুনা করতো। বুধবার তাদের পরীক্ষা ছিল। সে মঙ্গলবার ঢাকা থেকে রওনা দেয়। চাকরির জন্য ঢাকা গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তার সে আর ফিরে আসেনি।
বশির বেপরীর মত ইলিশা কান্দির গ্রামের সিরাজ পাটোয়ারী নাসরিন-১ লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ। তার লাশ পাওয়া যায়নি। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন। পরিবার একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কষ্টে দিন কাটিয়েছিলেন স্ত্রী পারুল বেগম। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, পড়াশুনা করছে। অভাব-অনাটনের মধ্যে দিন দিন কাটিয়েছেন তিনি। এখন ভালো আছেন। কিন্তু স্বজনহারা ব্যাথা এখনও ভুলতে পারছেন না পারুল বেগম।
পারুল বেগম বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে কেউ আমাদের খবর নেয়নি। অনেক কষ্টে করে ১৯ বছর পার করেছি।
সিরাজের ছেলে তুহিন বলেন, তখন তার বয়স এক বছর। সেই শিশুকালে বাবাকে হারিয়েছি। এ কষ্ট ভুলে যাবার নয়। বাবার কথা মনে হলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
জানা গেছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করার কারণে পানির প্রবল ঢেউয়ে নাসরিন-১-এর তলা ফেটে গেলে প্রায় ২ হাজারের বেশি যাত্রীসহ ডুবে যায়। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশেরই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ধারণা করা হয়, লঞ্চ ডুবিতে কমপক্ষে ৮শ' যাত্রীর সলিল সমাধি ঘটে।
এদের মধ্যে শুধু লালমোহনেরই যাত্রী ছিলেন ৪ শতাধিক। এছাড়া চরফ্যাশনসহ অন্য উপজেলারও কিছু যাত্রী ছিলেন। এরপর ২১টি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্বজনহারাদের সে আজও কান্না থামেনি। আজও সেই ভয়াল স্মৃতির কথা মনে করেন তারা। এ দিন এলেই তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই দুর্ঘটনায় অনেকেই সপরিবারে মারা যান। অনেক নিখোঁজদের লাশ পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার এক-দেড় মাস পরও নিহতদের লাশ লালমোহন, চরফ্যাশন, মনপুরা ও দৌলতখান সংলগ্ন মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন পাড়ে ভেসে উঠতে থাকে। অর্ধগলিত ওই লাশগুলো শেষ পর্যন্ত শনাক্তও করতে পারেননি স্বজনরা। অনেক লাশ আবার বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।
লালমোহন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন বলেন, লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা গেছে। তাদের মধ্যে লালমোহনে অনেক বেশি মানুষ। লঞ্চ মালিকপক্ষ যাতে ক্ষতিগ্রস্থ, নিহত ও নিখোঁজ পরিবারে সহায়তা করে সেই দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ রুটে আরো ভালো মানের লঞ্চ চলাচল করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি। পাশাপাশি নৌ পথে মানুষকে আরও সতর্ক হয়ে চলার আহ্বান জানান তিনি।
আরএ